নতুন বছরে শিক্ষার নতুন যুগে বাংলাদেশ

 

২০২৩ সালে শিক্ষার নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। শিখনফল কেন্দ্রিক শিক্ষাক্রম থেকে বেরিয়ে এই বছর থেকে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনে পরিবর্তিত হচ্ছে শিক্ষাক্রম। পুরো শিক্ষাক্রম তৈরি হয়েছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জনের একটি শিখন ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে। এতে পাল্টে যাচ্ছে গতানুগতিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাও। নতুন বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে দুদিন ছুটিও চালু হচ্ছে।

প্রথম বছর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি এবং প্রাথমিকের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পুরো বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ছিল। কিন্তু প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে প্রাথমিকের দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবার নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হয়েছে। এরপর ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। আর উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণি ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এর আগে বিভিন্ন সময় শিক্ষাক্রমে সামান্য পরিমার্জন করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, মাধ্যমিকে পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পাইলটিং করা হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে। নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে সে বই তুলে দেওয়া হয়েছে। শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ।

শিক্ষার নতুন যুগে প্রবেশের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, যোগ্যতা, মূল্যবোধ ও দক্ষতা বাড়াতে জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। যোগ্যতা নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার খোলনলচে বদলে ফেলছি। এখন শিক্ষায় পরিবর্তন ও সংস্কারের কথা বলছি না, ট্রান্সফরমেশনের কথা বলছি। শিক্ষার্থীদের শিখতে হবে। মুখস্থ পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পেয়ে পাস করা শিক্ষা দিয়ে চলবে না। সে জন্য আমরা নতুন কারিকুলাম করেছি প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা হবে আনন্দময়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে আনন্দ নিকেতন।’

নতুন শিক্ষাক্রম অভিভাবকদের গ্রহণ করার করার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কোনও কিছু খুব সহজে হয় না। শিক্ষাক্রম পরিবর্তন বড় বিষয়। সেই পরিবর্তন সহজ হবে না। এতে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবার সহযোগিতা লাগবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হয়নি। অথচ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন চলমান প্রক্রিয়া। ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হয়েছিল। এরপর আর হয়নি। ইতোমধ্যে এক ধরনের সনাতনী পরীক্ষানির্ভর সনদসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে গেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পেলে জিপিএ-৫ পেলেই শিক্ষার্থী পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুত হয়—এমনটা বলা যাবে না।’

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত সংঘাত বেড়েছে সারা পৃথিবীতে। সে জায়গায় নতুন করে অনেক কিছু ভাবার এবং করার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়াস নতুন শিক্ষাক্রমে লক্ষ্য করেছি। মুখস্থনির্ভর সনদসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়াস আমরা দেখেছি। সফট স্কিল, মানবিক মূল্যবোধ, ক্রীড়া, সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের নাগরিক হিসেবে তৈরি করা এবং তথ্য প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে দরকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মিথষ্ক্রিয়া বাড়ানো, মূল্যবোধ চর্চা করা। মূল্যবোধ শুধু শ্রেণিকক্ষে শেখানো সম্ভব নয়। সে জন্য শিক্ষার্থীর মেধা ও মননে বিকাশের জন্য একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেরা শিখবে অন্যকে উৎসাহিত করবে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, নতুন যুগের মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা। সরকার সেদিকে থাকতে চেষ্টা করেছে। নতুন কারিকুলাম গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে মনে হচ্ছে।’

নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলে অনেক চ্যালেঞ্জ ওঠে আসে। প্রথম হচ্ছে সব অংশীজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে এটিকে গ্রহণ করে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক কতটা শেখাচ্ছেন। সরকারের নানাবিধ মনিটরিং প্রয়োজন হবে শিক্ষক কীভাবে পড়াচ্ছেন। শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াও তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। অভিভাবকরা কীভাবে নিচ্ছেন তা ভাবতে হবে। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, মানবিক মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করবে এই শিক্ষাক্রম।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিখনফল কেন্দ্রিক ব্যবস্থা থেকে আমরা যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফলে যাচ্ছি। এর ফলে শিখন শেখানো সামগ্রীতে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। একইসঙ্গে শেখন শেখানো কৌশলেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। শিখন শেখানো কার্যক্রম আগে যেখানে পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন উৎস থেকে শিক্ষার্থীদের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আগে শিখন শেখানো কৌশলে শিক্ষক শুধু বক্তব্য দিয়ে যেতেন, বোর্ডে লিখে দিতেন বা মুখস্থ করবার কথা বলতেন, এখন সেখানে শিক্ষার্থীদের সহযোগী হিসেবে কীভাবে শিক্ষার্থী জানবে সেই কৌশল শেখাবেন। শিক্ষার্থীরা নিজেরা করে করে শিখবে। একইভাবে মূল্যায়নের জায়গাটাও পরিবর্তন হচ্ছে। আগে শিক্ষার্থীরা শিখন ফল অর্জন করেছে কিনা তা যাচাই করতাম পরীক্ষার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের কিছু বিষয় শুধু ব্যবহারিক থাকতো। আর এখন সারাবছর ধরে করে করে শিখবে, শুধু ল্যাবরেটরিতেই নয়, প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, সংবাদপত্র অনলাইনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে শিক্ষার্থী শিখবে এবং তাদের ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এক কথায় শিক্ষার্থী যা শিখবে তা প্রয়োগ করতেও শিখবে নতুন শিক্ষাক্রমে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তৈরি হবে। নিজের ভাষায় বর্ণনা করে লেখা ও বলার যোগ্যতা তৈরি হবে। তিন ঘণ্টার পরীক্ষা মধ্যে মূল্যায়ন থাকছে না। সারাবছর মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি শিক্ষক পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। সামষ্টিক মূল্যায়নেও ছয় মাসে বা এক বছরে যে যোগ্যতা তৈরি হওয়ার কথা তা তৈরি হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে নতুন করে অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন শিক্ষকরা।

সাপ্তাহিক দুদিন ছুটির বিষয়ে তিনি বলেন, সকল সরকারি অফিস সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে ছয় দিন। নতুন বছর থেকে সপ্তাহে দুদিন (শুক্র ও শনিবার) ছুটি চালু হচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের বাইরে থেকে শেখার জন্য একদিন সময় তৈরি হলো। একদিন বন্ধ থাকলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমাজের সঙ্গে চলার সুযোগ সীমিত হয়। শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে একদিন ছুটি যথেষ্ট নয়। প্রচুর পড়াশোনার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আরও একদিন ছুটি সে সুযোগ তৈরি করে দেবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় দেখা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের অভিলক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সকল শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশের চিন্তা মাথায় রেখে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষের সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি দেওয়া, সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শিক্ষাব্যবস্থার সকল পর্যায়ে দায়িত্বশীল, স্ব-প্রণোদিত, দক্ষ ও পেশাদার জনশক্তি নিয়োগ করা এবং যোগ্যতা নির্ধারণের প্রেরণা হিসেবে রাখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল হিসেবে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত চেতনা— মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিবেচনা করে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে।