চট্টগ্রামে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে ৩ শতাধিক অবৈধ ইটভাটা

 

চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলায় ইটভাটার অনুমোদন আছে ১২০টি। এর বাইরে আরও তিন শতাধিক ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে অনুমোদনহীনভাবে। অভৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

এদিকে হাইকোর্ট থেকে দেওয়া এক নির্দেশনায় বলা হয়, গত ১৩ নভেম্বর দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। এমন নির্দেশনা পেয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি ইটভাটা বন্ধ করেছিল প্রশাসন। বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার তালিকা করে তা জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিয়ে দায় সেরেছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার অজুহাতে ইটভাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে দাবি অধিদফতর কর্মকর্তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় যেসব ইটভাটা রয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই অনুমোদনহীন। যেসব ইটভাটা বৈধ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে সেগুলোতেও আছে নানা শুভংকরের ফাঁকি। চট্টগ্রামে বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে পাহাড় কেটে কিংবা ফসলি জমিতে। অনেক ইটভাটা রয়েছে লোকালয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে। এছাড়া পৌর এলাকায়ও রয়েছে অনেক ইটভাটা। এমনকি হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষেও অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে।

ভাটা-১
পাহাড় কেটে ও ফসলি জমিতে অবৈধ ইটভাটা
এদিকে গত ২৫ ডিসেম্বর রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ইটভাটার ছবি তুলতে গিয়ে ভাটা মালিক ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছেন ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’এর চট্টগ্রাম অফিসের স্টাফ রিপোর্টার আবু আজাদ। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পর কাঞ্চন তুড়ির নামে এক আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এখন পর্যন্ত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্যরা।

হামলার শিকার সাংবাদিক আবু আজাদ বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়ার রানীরহাট সংলগ্ন ইসলামপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। সবগুলোই গড়ে উঠেছে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে। আর কিছু ইটভাটা গড়ে উঠেছে ফসলি জমিতে এমনকি কোনও কোনও স্থানে পাহাড় কেটে পুকুরও খনন করা হয়েছে। ইটভাটাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের কাঠ। এসব দৃশ্যের ছবি তোলার কারণে ভাটা মালিক এবং তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার ওপর হামলা করেছে।

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানায়, জেলার ১৫টি উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে ফিক্স চিমনি (৮৯-১২০ ফুট উঁচু) ইটভাটা আছে ২৭৩টি, জিগজ্যাগ চিমনি আছে ১১৬টি এবং পরিবেশ ফ্রেন্ডলি টেকনোলজির ইটভাটা আছে মাত্র ১১টি। ইটভাটা পরিচালনার জন্য ছাড়পত্র আছে ১২০টির। সংস্থাটির হিসেবে আরও ২৯৩টি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে অনুমোদনহীনভাবে।

ইটভাটার মধ্যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় ১২টি ইটভাটার মধ্যে সবগুলোর অনুমোদন আছে। তবে আনোয়ারায় দুটির মধ্যে একটি, পটিয়ায় দুটির মধ্যে একটি, সন্দ্বীপে ১১টির মধ্যে ৯টি, বাঁশখালীতে ১২টির মধ্যে ১০টি, বোয়ালখালীতে ৫টির মধ্যে ৪টি, মীরসরাইয়ে ১৫টির মধ্যে ৯টি অবৈধ। এছাড়া সীতাকুণ্ডে ৮টির মধ্যে ৬টি, চন্দনাইশে ৩২টির মধ্যে ২৫টি, লোহাগাড়ায় ৪৮টির মধ্যে ৪৫টি, ফটিকছড়িতে ৫৫টির মধ্যে ৪৩ টি, সাতকানিয়ায় ৭০টির মধ্যে ৪৫টি, রাউজানে ৩৭টির মধ্যে ২৯টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টির মধ্যে ৬৬টি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৩৫টির মধ্যে ২০টি ইটভাটা অবৈধ বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবস্থার বন্ধ করা, ইটের বিকল্প ব্লক উৎপাদন ও ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ, ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক এবং ব্লক তৈরিতে লাইসেন্সের অপ্রয়োজনীয়তা, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ করা।

ভাটা-৩
এসব ইটভাটা হালদা নদীর জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ
এদিকে হালদা নদীর পাশ ঘেঁষেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। এসব ইটভাটা হালদা নদীর জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘এক সময় হালদার পাড় ঘেঁষে ১৩-১৪টি ইটভাটা ছিল। এর মধ্যে ১০-১২টি বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও হালদা নদীর পাড়ে মদুনাঘাট এলাকায় রয়েছে। হালদা নদীর ভেতরেও রয়েছে একাধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটা বন্ধে আমরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু নানা প্রভাবকাটিয়ে এসব ইটভাটা রয়ে গেছে। ইটভাটা নদী, মৎস্যসহ নদীর নানা জীব-বৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকি। হালদা নদীর পাড়ে থাকা ইটভাটা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

 

এদিকে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা আছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবমতে, এই উপজেলায় ইটভাটা আছে ৬৯টি। এর মধ্যে ৬৬টি ইটভাটা অবৈধ। তবে স্থানীয়রা জানান, উপজেলার ইসলামপুর, দক্ষিণ রাজানগর এবং রাজানগর ইউনিয়নেই রয়েছে প্রায় শতাধিক ইটাভাটা। অন্যান্য উপজেলাসহ এখানে প্রায় ১৩০টির মতো ইটভাটা রয়েছে, যার অধিকাংশতেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইসলামের আবদুল মোতালিব নামে এক ইটভাটার মালিক জানান, ইটভাটা নির্মাণের পর পরিবেশ অধিদফতরে লাইসেন্সর জন্য আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইটভাটা পেয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। কয়লার দাম বেশি এ কারনে কয়লা জ্বালানোর প্রতি ভাটা মালিকদের আগ্রহ কম। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ।

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো.মুফিদুল আলম বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। গত ২৬ ডিসেম্বরও সাতকানিয়ায় অভিযান চালানো হয়। তবে জনবল সংকটের কারণে যতটুকু অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন ততটুকু করা হচ্ছে না।’