মুসল্লিদের পদচারণায় দুই দিন আগেই মুখর টঙ্গির ইজতেমা ময়দান

 

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) থেকে। তবে এর দুই দিন আগেই বুধবার (১১ জানুয়ারি) থেকেই হাজার হাজার মুসল্লি টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে এসে অবস্থান নিয়েছেন। মুসল্লির দল মাঠের ভেতরে ঢুকে নিজ নিজ জেলার ‘খিত্তা’য় অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে ইজতেমা ময়দান প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে।

করোনার কারণে বিশ্ব ইজতেমা দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার আগামী শুক্রবার থেকে প্রথম পর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা ১৩, ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চার দিন বিরতি দিয়ে ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম পর্বের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলেম-ওলামা গ্রুপের যোবায়েরপন্থী অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বের নেতৃত্বে থাকছেন আদি তাবলিগ জামাতের নয়া দিল্লির মুরুব্বি মাওলানা সাদপন্থী গ্রুপের অনুসারী মুসল্লিরা।

বুধবার (১১ জানুয়ারি) ইজতেমা ময়দান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাস, ট্রাক, ট্রেন পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আসছেন। করোনার কারণে গত দুবছর ইজতেমা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবার তাবলিগের এ মহাসম্মেলনে যোগ দিতে আগেভাগেই এবার মুসল্লিরা মাঠে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। ময়দানে আসা মুসল্লিদের জমিয়ে রাখতে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) বাদ ফজর থেকে শুরু হবে আ’ম বয়ান। শীত উপেক্ষা করে বুধবার দুপুরের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় এসে অবস্থান নিচ্ছেন। বুধবার সন্ধ্যার আগেই প্রায় পুরো ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। ঢাকার কেন্দ্র থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে তুরাগ নদীর তীরে প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী এ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছে।

 

বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুন নূর জানান, প্রায় দুই মাস ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তাবলিগ অনুসারী মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠের প্রস্তুতি প্রায় সকল কাজ শেষ করেছেন। প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল মাঠটিকে বাঁশের খুঁটির উপর চটের ছাউনির প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়েছে। মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ ছাতা মাইক। বয়ান ও দোয়া মঞ্চ ছাড়া নামাজের মিম্বরও তৈরি করা হয়েছে আলাদাভাবে। দেশীয় তাবলিগের মুসল্লিদের জন্য জেলাওয়ারি আলাদা আলাদা স্থান (খিত্তা) ভাগ করা হয়েছে।

বিদেশি তাবলিগ অনুসারী মুসল্লিদের জন্য মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত আলাদা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ময়দান এলাকায় থাকছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, পুলিশ, র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম। আরব, ইউরোপসহ কয়েকটি দেশের মুসল্লিরাও ইতোমধ্যে ইজতেমা মাঠের বিদেশি মেহমানদের প্যান্ডেলে অবস্থান নিয়েছেন।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান জানান, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট টিম টহলে থাকবেন পুরো টঙ্গী জুড়ে। বুধবার সকালে ইজতেমা মাঠে দুটি গভীর নলকূপের উদ্বোধন করেন স্থানীয় এমপি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। বয়ান মঞ্চ করা হয়েছে ইজতেমা মাঠের পশ্চিম-উত্তরে মাঝ বরাবর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর মিয়া জানান, ৩১টি টয়লেট বিল্ডিংয়ে এক সঙ্গে ৯ হাজার মুসল্লি তাদের প্রস্রাব-পায়খানার কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। বিআরটিসি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে ইজতেমার মুসল্লিদের আনা নেওয়ায় বিশেষ বাস ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা নিয়েছে। ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর উপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫টি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে মুসল্লিদের এপার-ওপার হওয়ার জন্য।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলি (জিএমপি’র) কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুই পর্বে পোশাকে, সাদা পোশাকে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন ১০ সহস্রাধিক সদস্য। গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ বিভাগ ১৪টি কন্ট্রোলরুম তৈরি করেছে। র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম থাকবে, ডিএমপি তার এলাকায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে, ওয়াচ টাওয়ার, রুফটফ ডিউটিসহ সিআইডি, নৌপুলিশ, অবজারভারভেশন টিম থাকবে, র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল থাকবে। ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্টোল টিম, বোম ডিস্পোজাল টিম থাকবে। ১০হাজারেরও বেশি পুলিশ আনসার, র‌্যাব সদস্য পোশাক এবং সাদা পোষাকে ইজতেমার ভেতর বাহিরসহ টঙ্গী উত্তররার পুরো এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করবেন।

শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের সেবা কার্যক্রম প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য বিভাগ পাঁচটি ক্যাম্প স্থাপন কাজ চলছে। এখান থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। এসব ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প ছাড়াও টঙ্গী হাসপাতালে ডায়েরিয়া, অ্যাজমা, ট্রমা, বক্ষব্যাধি, ডেঙ্গু, নাক-কান-গলা, চক্ষু ও বার্ন ইউনিটের কার্যক্রম চলবে। এজন্য পর্যাপ্ত বেডও থাকবে। ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীর এ হাসপাতালে সাতটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন থাকবে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও ক্যাম্প বিন্যামূল্যে চিকিৎসা দেবে। চিকিৎসা বিভাগ ছাড়াও বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস সার্বক্ষণিক সেবাদান অব্যাহত রাখবে।

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশি মুসল্লি যারা আসেন তাদের এয়ারপোর্টে ইজতেমা আয়োজকরা রিসিভ করে থাকেন। বিদেশি মুসল্লিরা যাতে স্বাচ্ছন্দে ইজতেমায় আসতে পারেন সেজন্য ইমিগ্রেশন থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পকেটমারসহ নানা অপরাধ কার্যকলাপ রুখতে পেট্রোল টিম ও মোবাইল কোর্ট কাজ করবে। থাকবে ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ।

এদিকে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল ২০১৭ সালে আড়াই’শ শয্যায় উন্নীত হয়। হাসপাতালটি ১৮টি কেবিন চালু হচ্ছে। বুধবার বিকালে হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় একসঙ্গে সবকিছু করা সম্ভব নয়। ২০১৭ সালে সাধারণ বেড চালু করলেও কেবিন চালু করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কসহ সকলের অনুরোধে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১৮টি কক্ষের জন্য অত্যাধুনিক ১৮ টি বেড উপহার দিয়েছি। রোগীদের কেবিনে থাকার যে প্রত্যাশা ছিল এখন তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে। আগে কেবিন না থাকায় তারা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চলে যেতে হচ্ছে। এখন তারা বাড়ির কাছে ভালো সেবাটা পাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকলো না। ওই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ হাসপাতালের কেবিনে বেড দিতে পেরে ভালো লাগছে।’