চট্টগ্রামে ৫ লাখ টাকায় আপস হয়েছে খুনের মামলার! ক্ষমতার জোরে খালাস পেয়েছেন খুনের মামলায় অভিযুক্ত সব আসামি। ভয় দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে আসামিরা আপস করতে বাধ্য করেছেন বলে দৈনিক ঊনসত্তরের কাছে স্বীকার করেছেন মামলার বাদী।
এদিকে টাকা ও ক্ষমতার জোরে খুনের মামলার আপসে হতবাক আইনবিদরা। তারা বলছেন, খুনের মামলা কখনোই আপসযোগ্য হতে পারে না। এমন নজির প্রভাবশালীদের অপরাধে উৎসাহিত করবে।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁইয়ার আদালত ওই রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে খালাস পাওয়া আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— মিরসরাই আমবাড়িয়া এলাকার মৃত আবুল খায়েরের ছেলে মো. শাখের ইসলাম রাজু। তিনি পৌরসভার সাধারণ নির্বাচনে তিনবারের কাউন্সিলর ও বর্তমান প্যানেল মেয়র। অন্য আসামিরা হলেন— একই এলাকার নুরুল আবছারের ছেলে মো. জাহিদ হোসেন, আবুল কাশেমের ছেলে মো. তারেক, নুর আলমের ছেলে মো. ফরিদ ও নুরুল হুদা।
এদিকে খুনের মামলার আসামিরা খালাস পেলেও মামলার বাদী আব্দুল বাতেন নাকি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তিনি উল্টো প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘আসামিরা কি খালাস পেয়েছে? খালাস হয়েছে, ভালো হয়েছে।’
রায়ে সন্তুষ্ট কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা প্রভাবশালী মানুষ, আমি দিনমজুর। তাদের সঙ্গে মামলায় আমি পারবো না।
উচ্চ আদালতে আপিল করতে চান না কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তাদের সঙ্গে আপসে গিয়েছি। এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, মেম্বার-চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তারা আপসের জন্য বলেছিলেন। তাছাড়া আমার পরিবারের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাদের সঙ্গে আপসে গিয়েছি। তারা আমাকে ১০ লাখ টাকা দিবেন বলেছেন। এরমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। বাকি ৫ লাখ টাকা মামলা শেষ হলে দিবে বলে জানিয়েছেন। তবে যদি বাকি ৫ লাখ টাকা না পায় তাহলে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
তিনি আরও বলেন, আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। দিনে এনে দিনে খায়। এলাকার নেতারা সবসময় হুমকির মধ্যে রাখে। টাকা বা ক্ষমতা কোনোটা দিয়েই আমি তাদের সঙ্গে পারবো না।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকার আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক ঊনসত্তরকে বলেন, এটি আপস অযোগ্য ধারা। এ ধরনের মামলা আপস হলে প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত হবে। রাষ্ট্র এ মামলার বাদী। এ মামলা যদি রাষ্ট্র প্রমাণ করতে না পারে এটি রাষ্ট্রের জন্য দায় ও ব্যর্থতা। এ ধরনের মামলায় আপস করা একটি খারাপ নজির। বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ, পাচার, এসিড সন্ত্রাস— এসব মামলায় আপস করা ঠিক না।
তিনি আরও বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে মামলাগুলো এমন হচ্ছে। এ মামলায় উচ্চ আদালতে আপিল করে আসামিদের রিমান্ডে এনে নতুনভাবে আবারও ট্রায়ালে আনতে পারে।
এদিকে এ ঘটনায় হতবাক মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি দৈনিক ঊনসত্তরকে বলেন, এ ধরনের প্যানেল মেয়ররা থাকেন পলিটিকেল কাভারেজে। তারা সাধারণ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। মামলায় তাদেরকে কারাগারে পাঠালেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা জামিনে বেরিয়ে আসে।
হত্যা মামলা আপসযোগ্য নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, টাকার সঙ্গে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এমন আপস করে। ভিকটিম নিজের সুরক্ষা ও পরিবারের কথা ভেবে এমন আপসে যায়। তাছাড়া ভিকটিম জানে তাদের কিছুই হবে না। তারপরও তারা ঝুঁকি নিয়ে হুমকির মুখোমুখি হয়ে মামলা করেন। পরে বিভিন্ন চাপেও পড়েন। এ ধরনের ঘটনায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে ভুক্তভোগী। সে অবস্থায় তাদের টাকার টোপও দেওয়া হয়। এরা তখন ভাবে টাকা অল্প যদি আমরা নিয়ে নিই পরিবারও সুরক্ষিত থাকবে, কিছু টাকাও পেলাম।
এসব কারণে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, এ কারণে দুষ্কৃতিকারীরা নানা অপরাধ থেকে রেহাই পাচ্ছে। তারা আবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছে। এক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তখন তারা মামলা এমনভাবে সাজান যেখানে অপরাধীদের অপরাধ গোপন হয়। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল আদালতে দাখিল করেন না, যেসব বিষয় সামনে এলে অপরাধীরা শাস্তি পাবে। তারা উৎকোচ গ্রহণ করে এ ধরনের কাজ করেন বলে অভিযোগ করেন রানা দাশগুপ্ত।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৫ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরসরাই থানার জামশেদ কমিশনারের বাড়ির ভাড়া ঘর থেকে রাজু কমিশনারের লোক তারেক, ফরিদ ও জাহিদ এসে মো. শাহাদাত হোসেন আজিমকে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন ২৬ জুন ভোরে আজিমের বাবা মো. আব্দুল বাতেনকে প্রতিবেশী বাচ্চু মিয়ার মাধ্যমে ডেকে পাঠান রাজু।
আব্দুল বাতেন মিরসরাই পৌরসভা ৪ নং ওয়ার্ডের পূর্ব গোভনীয় এলাকায় রাজু কাউন্সিলরের হোপ মা ও শিশু হাসপাতলের ষষ্ঠ তলায় যান। সেখানে দেখেন, হাসপাতালের পরিচালক রাজুর অফিসের মেঝেতে আজিম বেহুশ অবস্থায় পড়ে আছে। তার দুটি দাঁত ভাঙা এবং সারা শরীরে জখমের চিহ্ন। সেখানে রাজু ছাড়াও তারেক, জাহিদ, ফরিদসহ অজ্ঞাত ২-৩ জন ছিলেন।
এসময় রাজুসহ তার সঙ্গীরা মুমূর্ষ আজিমকে আবারও বেধড়ক পিটিয়ে হাসপাতালের নিচে নামায়। সেখানেও আজিমকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কালো একটি প্রাইভেট কারে তুলে দেন রাজু। হাসপাতাল ছাড়ার সময় রাজু হুমকি দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে যেন কাউকে কিছু বলা না হয়। তারা যেন দ্রুত মিরসরাই ছেড়ে চলে যায়।
রক্তাক্ত আজিমকে নিয়ে সেই গাড়িতে করে নিজ বাডি ফেনীর দাগনভূইয়ায় রওনা হন আব্দুল বাতেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ফেনী মহিপাল এলাকায় গাড়ির ভেতরেই মারা যান আজিম।
ভয়ের মধ্যে থাকা বাতেন ছেলের লাশ নিয়ে হাসপাতাল বা থানায় না গিয়ে সরাসরি নিজ গ্রামের বাড়ি যান। সেখানে আত্মীয়-স্বজনরা আজিমের শরীরের ক্ষত দেখে দাগনভূইয়া থানা পুলিশকে জানায়।
পরদিন সকাল ৯টার দিকে পুলিশ এসে আজিমের লাশ দাগনভূইয়া থানায় নিয়ে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ফেনী সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। সেদিন রাতেই শাখের ইসলাম রাজু, জাহিদ, তারেক, ফরিদসহ ২ থেকে ৩ জন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে মিরসরাই থানায় মামলা দায়ের করেন আব্দুল বাতেন। পরদিন মামলার আলামত হিসেবে রক্তমাখা তোষক ও একটি ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার জব্দ করে পুলিশ।
তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মিরসরাই থানার এসআই দীনেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ওয়ালীউল্লাহ। এতে পুলিশ-ডাক্তারসহ ১৭ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। চার্জশিটে উঠে আসে অটোরিকশা চালক নুরুল হুদার নাম।
এদিকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আসামি জাহিদ হোসেন উল্লেখ করেন, অটোরিকশা চালক নুরুল হুদা ফোন করে তাকে হাসপাতালের ৬ তলায় যেতে বলেন। রাত সাড়ে ১২টায় সেখানে গিয়ে দেখি, রাজু কমিশনার আজিমকে মারছিল। সে নাকি রাজু কমিশনারের নাম দিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। ওইসময় আমিও (জাহেদ) আজিমকে মারধর করি। ঘটনাস্থলে থাকা তারেক, ফরিদ, নুরুল হুদাও আজিমকে মারধর করেন। এদের মধ্যে তারেক রাজু কাউন্সিলরের গাড়ির ড্রাইভার। পরে রাজু কমিশনারকে অনুরোধ করে আজিমের বাবাকে ডেকে পাঠাই। তাদের গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় আজিম পানির জন্য চিৎকার করছিল। তবে আজিমকে বেশি মেরেছে রাজু কাউন্সিলর।
এদিকে ময়নাতদন্ত রিপোর্টেও উল্লেখ রয়েছে, আঘাতজনিত অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে আজিমের মৃত্যু হয়েছে।