কুতুবদিয়া (Kutubdia) কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি দ্বীপ উপজেলা। নানান রকম বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার। এই দ্বীপে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সমুদ্র সৈকত, লবণ চাষ, বাতিঘর এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার।
ইতিহাস
ধারণা করা হয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে সাগরের বুকে কুতুবদিয়া দ্বীপ জেগে উঠে। আর এই দ্বীপে মানুষের পদচারণা শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ‘কুতুবুদ্দীন’ নামে এক পরহেজগার ব্যক্তি এ দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। পরবর্তীতে আরাকান থেকে বিতাড়িত মুসলমানরা যখন এই দ্বীপে আসতে শুরু করে তখন কুতুবুদ্দীন এদের আশ্রয় প্রদান করেন। শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে কুতুবুদ্দীনের নামানুসারে এ দ্বীপের না রাখা হয় ‘কুতুবুদ্দীনের দিয়া’ যা পরবর্তীতে ‘কুতুবদিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
কুতুবদিয়া দ্বীপের দর্শনীয় স্থান
কুতুবদিয়া চ্যানেল: মাগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া দ্বীপে যাবার সময় এই চ্যানেলটি পাড়ি দিতে হবে। শীতকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এটি বেশ উত্তাল থাকে।
কুতুব আউলিয়ার দরবার: কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফ দেখতে আপনাকে যেতে হবে দ্বীপের ধুরং এলাকায়। এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুবী ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মৃত্যু বরণ করেন ২০০০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছর ৭ ফাল্গুন শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুবীর মৃত্যুবার্ষিকীতে হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে।
বাতিঘর: বহুবছর আগে সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজেকে পথ দেখাতে কুতুবদিয়ায় একটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছিল, ভাটার সময় সেই বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। সমুদ্র সৈকত ধরে উত্তর দিকে গেলে বর্তমানে নির্মিত নতুন বাতিঘর দেখতে পাবেন।
সমুদ্র সৈকত: কুতুবদিয়ায় রয়েছে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। নির্জন এই সৈকতে পর্যটকের আনাগোনা খুব কম তবে এখানে জেলেদের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ে। সৈকতের প্রধান বৈশিষ্ট হল এখানে প্রচুর গাংচিল ঘুরে বেড়ায়। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত।
বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র: কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে প্রায় এক হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
লবণ চাষ: শীতকালে কুতুবদিয়ায় লবণ চাষ করা হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ উৎপাদন দেখতে হলে চলে আসতে পারেন কুতুবদিয়ায়।
ঢাকা থেকে কুতুবদিয়া দ্বীপ
ঢাকা থেকে কুতুদিয়া যেতে হলে প্রথমে কক্সবাজার এর চকরিয়া উপজেলার বাস স্ট্যান্ড এ গিয়ে সেখান থেকে মগনামা ঘাট হয়ে কুতুবদিয়া যেতে হবে। ঢাকা থেকে সোহাগ পরিবহন, টি আর ট্রাভেলস, গ্রীন লাইন পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, এস আলম, শ্যামলী, ইউনিক, ঈগল ইত্যাদি এসি/ নন-এসি বাস কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন যাত্রা করে। বাস ভেদে ভাড়া লাগবে ৯০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। এসব বাসে করে কক্সবাজার এর চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড নামতে হবে।
চট্রগ্রাম থেকে কুতুবদিয়া দ্বীপ
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ড কিংবা নতুন ব্রিজের বাস স্ট্যান্ড থেকে চকরিয়ায়/কক্সবাজার গামী যে কোন বাসে করেই চকরিয়া যাওয়া যায়। তবে জে.বি. এক্সপ্রেস, এস আলম কিংবা সৌদিয়া ডাইরেক্ট বাসে যাওয়া ভালো। ১৫০-১৮০ টাকা বাস ভাড়ায় চকরিয়া যেতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই থেকে প্রায় তিন ঘন্টার মত। চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল সিএনজি করে জনপ্রতি ৬০-৮০ টাকা ভাড়ায় (রিজার্ভ ২৮০-৩২০ টাকা) মগনামা ঘাটে যেতে হবে। সময় লাগবে আনুমানিক ৪০-৫০ মিনিট। এছাড়া চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ থেকে সিএনজি দিয়ে জনপ্রতি ১৮০ টাকা ভাড়ায় ২-৩ ঘন্টা সময়ে যেতে পারবেন মগনামা ঘাট। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গা বাজার থেকে সকাল ৭ টায় জনপ্রতি ১০০ টাকায় ইঞ্জিন কাঠ বোটে সরাসরি কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ঘাঠে যাওয়া যায়।
কক্সবাজার থেকে কুতুবদিয়া
কক্সবাজার থেকে চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড হয়ে মগনামা ঘাটে যাওয়া যায় কিংবা কক্সবাজার থেকে মহেশখালি নৌপথে গিয়ে মহেশখালি থেকে সড়কপথে মগনামা ঘাট যাওয়া যায়।
চকরিয়া থেকে কুতুবদিয়া
চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল সিএনজি করে জনপ্রতি ৬০-৮০ টাকা ভাড়ায় (রিজার্ভ ২৮০-৩২০ টাকা) মগনামা ঘাটে যেতে হবে। সময় লাগবে আনুমানিক ৪০-৫০ মিনিট। মাগনামা ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে ১৫-২০ টাকা ভাড়ায় ২০ মিনিটে অথবা স্পিড বোটে ৬০-৮০ টাকা ভাড়ায় ৭-৮ মিনিটেই কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে পৌঁছে যাবেন কুতুবদিয়া দ্বীপে। মগনামা ঘাট থেকে স্পিড বোটে বড়ঘোপ ঘাট কিংবা দরবার ঘাটের যেকোনো এক ঘটে যাওয়া যায়। কুতুবদিয়া দ্বীপের ঘাট থেকে বড়ঘোপ বাজার যেতে ২০ থেকে ৩০ টাকা রিক্সা ভাড়া লাগবে।
একদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা ও খরচ
চট্রগ্রাম থেকে খুব সকালে রওনা দিলে বায়ু বিদ্যুৎ ও লাইট হাউস দেখে দিনের বেলায় ফিরে আসা যাবে। যাওয়া আসায় ৬-৭ ঘণ্টা লাগবে, বাকি সময় ঘুরে দেখতে পারবেন। বড়ঘোপ বাজার থেকে ৩০-৪০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় কিংবা ৫-১০ টাকা টেম্পু ভাড়ায় বায়ু বিদ্যুৎ প্লান্টে যাওয়া যায়। বায়ু বিদ্যুৎ প্লান্ট দেখে রিক্সায় হাসপাতাল গেট এসে, হাসপাতাল গেইট থেকে সিএনজি কিংবা রিকশায় কিংবা জিপে করে দরবারের গেইটে যাওয়া যায়। ওখান থেকে কুতুবদিয়া লাইটহাউস দেখা যায়। সব দেখে শেষ স্পিড বোট ছাড়ার আগেই ঘাঁটে ফিরে আসতে হবে।
কোথায় থাকবেন
পর্যটকদের থাকার জন্য কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ বাজারে ‘হোটেল সমুদ্র বিলাস’ নামে একটি আবাসিক হোটেল চালু আছে। সমুদ্রের খুব কাছে হওয়ায় এই হোটেলে বসে সমুদ্র দেখা করা যায়। এখানে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিভিন্ন ধরণের নন-এসি রুম পাওয়া যায়। যোগাযোগ করার জন্য ফোন করতে পারেন 01819647355 এবং 01722086847 মোবাইল নাম্বারে।
এছাড়া ক্যাম্পিং এর জন্যে আদর্শ কুতুবদিয়া দ্বীপ। নিরিবিলি সৈকতের কাছে ক্যাম্পিং করার জন্যে অনেকেই এই দ্বীপকে বেছে নেন। নিরাপত্তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। তারপরেও প্রয়োজন মনে হলো স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে নিন।
কোথায় খাবেন
খুব ভালো কোন রেস্টুরেন্ট না থাকলেও কুতুবদিয়া দ্বীপের বাজারের স্থানীয় হোটেল গুলোতে শুঁটকি, ভর্তা, নানা ধরণের মাছ ও মাংস দিয়ে উদর পুর্তি করতে পারবেন। বড়ঘোপ বাজারের “নিউ মদিনা” কিংবা “ক্যাফে আলম” তুলনামূলক ভালো খাবার পাওয়া যায়।
ভ্রমণ টিপস
কুতুবদিয়া দ্বীপে কোন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই, এখানে জেনারেটর ও সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয়। সাগরের জোয়ার-ভাটা নির্নয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তাই সাগরে নামতে হলে নিজ উদ্যোগে জোয়ার-ভাটার সময় জেনে নিতে হবে। অবশ্যই ভাটার সময় সাগরে নামা থেকে বিরত থাকুন। স্পিড বোট ও ইঞ্জিন নৌকায় দ্বীপ থেকে ছেড়ে আসার শেষ সময়টা আগেই জেনে রাখুন। সাধারণত সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্পিড বোট ও ইঞ্জিন নৌকা চলাচল করে।