চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনেই ‘হেলাল স্টোরে’ বসে চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প করছেন কয়েকজন কারারক্ষী। তাদের সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন বন্দির স্বজন। গল্পের এক ফাঁকে কারারক্ষীকে কাগজে টাকা মুড়িয়ে হাতে গুঁজে দিলেন এক বন্দির স্বজন। এই টাকা দেওয়া হয়েছে বন্দি থাকা আসামির হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
এর মধ্যে আরেকজন কারারক্ষীকে দেখা গেল সেই দোকান থেকে নগদে টাকা উত্তোলন করতে। ‘এই টাকা পাঠিয়েছেন, কারাগারের এক বন্দির স্বজন। ওই বন্দি আসামির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য’—পান চিবিয়ে চিবিয়ে হেলাল স্টোরের মালিক রিজভীকে কথাগুলো বলছিলেন ওই কারারক্ষী।
তবে এসব টাকা বন্দির হাতে পৌঁছে দেওয়ার পেছনেও রয়েছে ধান্ধার হিসেব। টাকার বন্দির হাতে পৌঁছে দিতে কমিশন নেন এসব কারারক্ষী। টাকার অংকের ওপর নির্ভর করে সেই কমিশনের পরিমাণ। প্রতি ১০০০ টাকায় ২০০ টাকা, ২ হাজারে ৩০০ টাকা, ৩ হাজারে ৩০০ টাকা এবং ৫ হাজার টাকায় ৫০০ টাকা কমিশন দিতে হয় কারারক্ষীকে।
সরেজমিন কারাগার ফটকের সামনে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। আরও দেখা গেছে, কারাগারের সামনের ফটকের কাছে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বন্দির স্বজনরা। বন্দিদের কাছে নগদে টাকা পাঠাচ্ছেন তারা।
ফটকের সামনে থাকা কয়েকটি দোকানে বিকাশ ও নগদে টাকা পাঠান বন্দির স্বজনরা। পরে যে কারারক্ষীর নামে পাঠানো হয় তিনি এসে টাকা উত্তোলন করে কমিশনের বিনিময়ে বন্দির কাছে পৌঁছে দেন। আর কারারক্ষীদের মাধ্যমে পাঠানো টাকা সরাসরি বন্দির হাতে জমা হয়।
অথচ কারা বিধান অনুসারে জেলের ভেতর এভাবে নগদ টাকা লেনদেন ও খরচ করার কোনো নিয়ম নেই।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে চায়ের স্টল ও দোকান আছে ১০ থেকে ১২টি। এখানকার হেলাল স্টোর, বিসমিল্লাহ স্টোর, রুহুল আমিনের চায়ের দোকানসহ প্রায় প্রায় দোকানে নগদ ও বিকাশের লেনদেন হয়। এসব দোকানগুলোতে এভাবে বন্দির স্বজনদের টাকা আসে। আর এসব টাকা কারারক্ষীরা কমিশনের বিনিময়ে বন্দিদের হাতে পৌঁছে দেন। এভাবে প্রতিটি দোকানে দিনে লাখ টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়।
কারা সূত্রে জানা গেছে, কারাবন্দিদের আত্মীয়-স্বজনদের টাকা গ্রহণে মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এতে ক্যাশ আউট করার খরচসহ সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পাঠানো যাবে। তবে একবারে ১ হাজার টাকা বেশি পাঠানো যাবে না। এই টাকা কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দিদের নামে খোলা অ্যাকাউন্টে (যা প্রিজনার্স অ্যাকাউন্ট নামে পরিচিত) জমা থাকে। ক্যান্টিনে খাওয়া-দাওয়া, মোবাইল ফোনের বিলসহ বিভিন্ন কাজে এই অ্যাকাউন্টের টাকা থেকে তারা ব্যয় করতে পারেন।
কারাগারের বন্দির সংখ্যা অনুসারে অ্যাকাউন্ট খোলার সংখ্যাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে নির্দেশনায়। এক্ষেত্রে ৫০০ পর্যন্ত বন্দি থাকলে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। তবে বন্দির সংখ্যা এক হাজারের মধ্যে হলে দুটি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দির সংখ্যা ১০০১ থেকে তিন হাজার হলে তিনটি অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। এর বেশি বন্দি থাকলে পাঁচটি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
এসব অ্যাকাউন্ট শুধু মোবাইল ফোনে টাকা গ্রহণের কাজে ব্যবহার হবে। যা এজেন্ট নম্বর হিসেবে কাজ করবে। টাকা পাঠানোর পর একটি এসএমএসে বন্দির নাম, বাবার নাম ও ঠিকানাসহ যে মোবাইল ফোন থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে সেটির নম্বর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বন্দির হিসাবে টাকা জমা হওয়ার বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বন্দিকে অবহিত করা হবে।
তবে কারাগারে এভাবে টাকা লেনদেনের পেছনে রয়েছে অন্য ঘটনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজতিদের কারাগারে প্রবেশের আগে তাদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা একটি খাতায় (পিসি বই) লিপিবদ্ধ করে কারা কর্তৃপক্ষ। ওই সময় বইয়ে হাজতির তথ্য ভুল লিখে দেন দায়িত্বরতরা। ফলে জামিন হলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। নামের গড়মিলের কারণে জামিন পাওয়ার পরও একদিন বেশি থাকতে হয় জেলে। তবে গেটে থাকা দায়িত্বরত কারারক্ষীকে ১ হাজার টাকা দিলেই সব ঠিক হয়ে যায়।
এছাড়া একজন হাজতি কারাগারে প্রবেশের পর তাকে প্রথমদিন আমদানিতে রাখা হয়। পরে তাদের অপরাধ অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু এখানেও রয়েছে টাকার খেলা। যে কেউ চাইলেই আমদানিতে বিছানা পাবেন না। বিছানা পেতে হলে তাকে গুনতে হবে ১ হাজার টাকা, না হয় থাকতে হবে মেঝেতে।
কারাগারে খাবার নিম্নমানের হওয়ায় ক্যান্টিন থেকে চড়া মূল্যে মাছ ও মাংস কিনে খেতে টাকার দরকার হয় বন্দিদের। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, যারা টাকা আনতে পারেন তারাই ভালমন্দ খেতে পারেন। এছাড়া একটু ভালোভাবে গোসল করার জন্যও টাকা গুনতে হয়। স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারের ভেতর থেকেও বন্দিদের নগদ টাকা দিতে হয় কারারক্সীদের হাতে।
এমনকি টাকার খেলা চলে কারাগারের মেডিকেলে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও। কারাবিধি অনুযায়ী, যে রোগী আগে যাবে সে মেডিকেলে সিট পাবে। কিন্তু সেখানে টাকা দিলেই আগে পাওয়া যায় সিট। মেডিকেলে ১৫ দিন থাকার জন্য দেড় হাজার টাকা এবং এক মাস থাকার জন্য আড়াই হাজার টাকা গুনতে হয় বন্দিদের।
কারাগারের ভেতর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তার জন্যও বন্দিদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়। অথচ এসব অনুষ্ঠানের খরচ আসে সরকারি কোষাগার থেকেই।
এই বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘নগদের মাধ্যমে টাকা লেনদেন ও বাইরে কারারক্ষীদের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের অভিযোগ কানে আসেনি। আমি নতুন এসেছি। তবে অভিযোগটির বিষয়ে খোঁজ নেবো।’