চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রক্টরসহ ১৮ পদে ১৬ জন রবিবার (১২ মার্চ) দুপুরে পদত্যাগ করেছেন। তাদের দাবি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে এই পদত্যাগ। কিন্তু একসঙ্গে এত শিক্ষকের পদত্যাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই বলছেন, উপাচার্যের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদত্যাগকারীদের বেশিরভাগই উপাচার্যপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হলে দীর্ঘদিন ধরেই তারা পদত্যাগের হুমকি দিয়ে আসছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে। উপাচার্যের বক্তব্যেও এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এদিকে, পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তদবির করতে শিরীণ আখতারসহ বেশ কয়েকজন ঢাকায় অবস্থান করছেন। এমন অবস্থায় একযোগে ১৬ জন পদত্যাগ করলেন।
প্রক্টরিয়াল বডি থেকে পদত্যাগকারীরা হলেন– প্রক্টর অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া, সহকারী প্রক্টর ড. শহীদুল ইসলাম, এসএএম জিয়াউল ইসলাম, ড. রামেন্দু পারিয়াল, শাহরিয়ার বুলবুল তন্ময়, গোলাম কুদ্দুস লাভলু। এরমধ্যে প্রক্টর অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আব্দুর রব হলের প্রভোস্ট এবং সহকারী প্রক্টর শাহরিয়ার বুলবুল তন্ময় শাহজালাল হলের আবাসিক শিক্ষক পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া পদত্যাগ করেছেন ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) অতিরিক্ত পরিচালক ড. ওমর ফারুক।
বিভিন্ন হলের আবাসিক শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগকারীরা হলেন– এফ রহমান হলের অনাবিল ইহসান, প্রীতিলতা হলের ফারজানা আফরীন রূপা, শহীদ আব্দুর রব হলের ড. এইচএম আব্দুল্লাহ আল মামুন ও রমিজ আহমদ, শামসুন্নাহার হলের শাকিলা তাসমিন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলের নাসরিন আক্তার, ড. শাহ আলম ও উম্মে হাবিবা এবং আলাওল হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক ঝুলন ধর।
পদত্যাগের কারণ জানতে চাইলে প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। বিভিন্ন সময় গবেষণার কাজ ও অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততার কারণে এ দায়িত্ব থেকে আরও আগেই সরে আসতে চেয়েছিলাম। সর্বশেষ আজ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।’
আলাওল হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক ঝুলন ধর বলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। বাকিটা কো-ইনসিডেন্ট।’
প্রীতিলতা হলের আবাসিক শিক্ষক ফারজানা আফরিন রুপা জানান, তিনি পারিবারিক কারণে পদত্যাগ করেছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পদত্যাগকারী জানান, চ্যান্সেলর কর্তৃক মনোনীত দুই সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল মনছুর ও অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলামের পরামর্শে চলছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। কিন্তু দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা প্রক্টরিয়াল বডি ও অন্য শিক্ষকদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না তিনি।
প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগকারী একাধিক সদস্য বলেন, ‘উপাচার্য দুজন সিন্ডিকেট সদস্যের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। আমাদের কাছ থেকে কোনও পরামর্শ নেন না। কিন্তু যা কিছু ঘটছে তার দায়ভার আমাদের ওপর পড়ছে। উপাচার্য কোথাও আটকে গেলে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের ওপর দায় চাপিয়ে দেন।’
প্রক্টরিয়াল বডির এক সদস্য বলেন, ‘আমরা গত বছরের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ক্যাম্পেইন করেছিলাম। তখন শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিই। উপাচার্য সেসব পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। এতে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন উপাচার্যকে সতর্ক করে এলেও তিনি গুরুত্ব দেননি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদত্যাগ করা আরেকজন বলেন, ‘উপাচার্য প্রশাসনিক কাজে এমন লোক চান, যারা তার সব কাজে শুধুই সমর্থন দেবেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কারণে প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরকে তিনি পদত্যাগের নির্দেশ দেন। উপাচার্য আর তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। আর এই কারণে প্রক্টরিয়াল বডিসহ বিভিন্ন হল প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরাও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
তবে কেউ কেউ বলছেন, মতবিরোধ হওয়ায় উপাচার্য নিজেই তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। প্রক্টরের পদত্যাগের মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে নতুন প্রক্টর নিয়োগ দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘তারা তিন মাস আগে থেকে বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রশাসনবিরোধী কথা বলছেন। যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের সবাইকে রবি (প্রক্টর) নিয়োগ দিয়েছেন। তারা যা বলছেন, সব মিথ্যা। তাদের কিছু এজেন্ডা ছিল, একে ওকে প্রোভাইডেড করবে, হয়তো তাদের ওপরও চাপ ছিল বিভিন্ন জায়গার। আমি তাদের কথায় সায় দিতে পারিনি। তাদের দু-একজনের নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু ছিল, সেগুলো এখন বলবো না। দু-একজনের ব্যক্তিগত কিছু চাওয়া-পাওয়াও ছিল। তাদের একটা দাবি পূরণ না হওয়ার ক্ষেত্রে সিনিয়রদের প্রতি তাদের অবজ্ঞা এসেছে। এর প্রতিফলন তারা দেখে নেবে বলেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানতাম এমন কিছু ঘটতে পারে। তাই ভেতরে ভেতরে আমিও তাদের বিকল্প তৈরি করে ফেলেছি।’
উল্লেখ্য, অধ্যাপক রবিউল হাসান ভূঁইয়ার পদত্যাগের আধাঘণ্টার মাথায় ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নূরুল আজিম সিকদারকে প্রক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রভাষক মো. রোকন উদ্দিন ও মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের প্রভাষক সৌরভ সাহা জয়কে সহকারী প্রক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।