চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা এলাকার সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। দেড় বছর ধরে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে তারা একসঙ্গে এমনটি করে আসছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার (১১ জুন) সকালে নগরের কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত এক শিক্ষককেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সন্ধ্যায় নগরের বাকলিয়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার শিক্ষক হলেন— জীববিজ্ঞানের রকিব উদ্দিন (৩৫)। অভিযুক্ত অন্যজন অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক সুরজিৎ পাল (৩৩)।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার হুমকিসহ নানারকম ভয় ভীতি দেখিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে একসঙ্গে যৌন নিপীড়ন করে আসছিলেন এই দুই শিক্ষক। এমনকি অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ‘প্রশ্রয়’ দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের বিরুদ্ধে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক জানান, অভিযুক্ত দুই শিক্ষক পাঠদানের সময় প্রায়ই ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। তাঁরা বিষয়ভিত্তিক পাঠদান বাদ দিয়ে অশালীন ও আপত্তিকর বিষয়ে কথাবার্তা বলেন।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম ওবায়েদুল হক বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন এক অভিভাবক। অভিযুক্ত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে অভিযুক্ত শিক্ষক সুরজিৎ পাল বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ফেক আইডি খুলে আমার কয়েকজন সহকর্মী আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে। এ ঘটনায় স্কুল তদন্ত কমিটি করেছে।’
গ্রেপ্তারের আগে অভিযোগ প্রসঙ্গে আরেক শিক্ষক রকিব উদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে কয়েকদফা যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
একই বিষয়ে জানতে সেন্ট স্কলাসটিকাস্ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শিল্পী সেলিন কস্তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৯ জুন সকাল ১০টার দিকে টিফিন বিরতির সময় অভিযুক্ত দুই শিক্ষক কৌশলে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীকে ৬ তলার বাথরুমের পাশে নিয়ে যান। সেখানেই অবাঞ্ছিতভাবে ওই ছাত্রীকে স্পর্শ করে শ্লীলতাহানি করেন। তাদের এমন আচরণে ভয় পেয়ে চিৎকার দিলে ওই ঘটনা কাউকে না জানানোর হুমকি দিয়ে কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান তারা। ভুক্তভোগী ছাত্রী ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানায়নি। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে কান্নাকাটি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ছাত্রীর মা কান্নার কারণ জানতে চাইলে ঘটনার বিস্তারিত বলে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীকে প্রায় দেড় বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ক্রমাগত বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করে আসছেন দুই শিক্ষক। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রীর অভিভাবক স্কুলের এক শিক্ষককে জানালে একে একে স্কুলের সব শিক্ষক, অভিভাবকদের মোবাইলে টিকটকের কথোপকথনের স্ক্রিনশট চলে যায়। এ নিয়ে গত এপ্রিলে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শিল্পী সেলিন কস্তার কাছে অভিযোগ জানালেও এ বিষয়ে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চট্টগ্রামের আর্চডাইয়োসিসের আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদারের কাছে অভিযোগ জানালে তিনি গত ২৬ মে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। তারপর থেকেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি ধমকি দিতে শুরু করেন অভিযুক্ত দুই শিক্ষক। এ নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতি অনাস্থা এনে গত ৪ জুন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘বাচ্চারা তো ভয় পায়। ওরা (শিক্ষার্থীরা) অভিযোগ করার মত ওইরকম সাহস এখনো পায়নি। তাদের নিপীড়নের ঘটনার স্বাক্ষী আমাদের অনেক শিক্ষক। কিন্তু সেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধান গুরুত্বই দিচ্ছে না, বাচ্চার পরিবার এগিয়ে আসছে না সেখানে আমাদের কী করার আছে। তার উপর ওই ছাত্রীর অভিভাবক এতোদিন ভয়ে কোনো কথা বলেননি। বদনাম হবে ভেবে চুপ করে ছিলেন। এ ঘটনার পিছনে সবচেয়ে বড় দায় আমাদের প্রধান শিক্ষকের। তিনি বিষয়টি জানার পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে উল্টো তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন।’
প্রশ্রয় দেওয়ার কারণ কী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমাদের স্কুলের কলেজ শাখা অনুমোদন পায়। কিন্তু তেমন ছাত্রী নেই। ওই দুই শিক্ষকসহ আরও কয়েকজন কোচিং সেন্টার চালান আর তারা ছাত্রী নিয়ে আসেন। যে কারণে এতো বড় কেলেংকারির পরেও অধ্যক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমরা যারা প্রতিবাদ করেছি তাদেরই হুমকি ধমকি দেওয়া শুরু করেছে।’